হাঁটু বা শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য ভিটেমাটি বিক্রি করে বিদেশে যাওয়ার আর কোন প্রয়োজন নেই। দেশের চিকিৎসকরাই জটিল সব অস্ত্রোপচার সফলভাবে করতে সক্ষম। আমাদের চিকিৎসা সেবা এখন বিশ্বমানের।
এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুর্নবাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর)-এর পরিচালক ডা. মো. আবুল কেনান।
তিনি বলেন, ‘এ জাতীয় চিকিৎসা বা পরিবেশ পরিস্থিতি সব দিক বিবেচনা করলে নিটোরের চিকিৎসা ব্যবস্থা খুব ভালো বলে আমি মনে করি। এখানে আমরা প্রতিদিন হিপ রিপ্লেসমেন্ট, হাঁটু প্রতিস্থাপন, হাতের জটিল সার্জারি, শিশুদের হাড়ের অপারেশন এবং মেরুদণ্ডের অস্ত্রোপচার করছি। এসব চিকিৎসার জন্য অনেকেই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, সিঙ্গাপুর কিংবা ব্যাংককে যান। সামর্থ্যবান যারা তাদের বিষয়ে আমার কোন বক্তব্য নেই। কিন্তু অনেকেই জানেন না যে এসব অপারেশন দেশে সফলভাবে করা যায়, তাই তারা বাড়ি, গাড়ি, জমিজমা কিংবা গরু বিক্রি করে বিদেশগামী হন। তাদের প্রতি আমার অনুরোধ, এসব অপারেশনের জন্য এখন আর বিদেশ যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।’
ডা. আবুল কেনান আরো বলেন, ‘ইউকে, আমেরিকা, চীন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ব্যাংকক থেকে অনেক চিকিৎসক আমাদের এখানে এসেছেন। তারা সবাই নিটোরের চিকিৎসা সেবার প্রশংসা করেছেন। তাদের ভাষায়, প্রতিষ্ঠানটির সেবার মান অত্যন্ত সন্তোষজনক। এখানকার অপারেশন সিস্টেম, ওটির ধরণ খুবই ভালো। ফলে এখান থেকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার কোন দরকার নেই বলেও মনে করেন তারা।
নিটোর পরিচালক বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসার জন্য আমরা বিদেশ থেকে চিকিৎসক এনেছিলাম। তারা বলেছেন, ‘আমাদের অনর্থক ঢাকায় নিয়ে এসেছেন। আমাদের এখানে আনার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আপনাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা ও মান আন্তর্জাতিক মানের।’
সড়ক দুর্ঘটনা কেন বাড়ছে? এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. আবুল কেনান বলেন, ‘বাংলাদেশের সড়কগুলোর যে ইনফ্রাস্ট্রাকচার (অবকাঠামো), সেগুলো অনেক জায়গায় ঠিক নেই। বিভিন্ন জায়গায় রাস্তা ভাঙা থাকে যেগুলো পরে ঠিকমতো মেরামত করা হয় না। এমন অবস্থায় গাড়ি চলাচল করলে চালকদের জন্য গতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এটি দুর্ঘটনার একটা কারণ হতে পারে। তাছাড়া অধিকাংশ গাড়ির ফিটনেস প্রায়ই খারাপ থাকে। গাড়িগুলো যে রকম ভাবে ফিট থাকার কথা সেভাবে ফিট থাকে না এবং এগুলোর ফিটনেস ঠিকমত যাচাইও করা হয় না। ফলে কোনোরকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই গাড়িগুলো রাস্তায় চলে। আর আনফিট গাড়ি যখন রাস্তায় থাকে সেখানে তার গতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। সেগুলোই অনেক সময় দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’
তিনি বলেন, সকল ড্রাইভারকে যদি চেক করা হয়, তাহলে দেখা যাবে যে অনেকের লাইসেন্সই নেই। এমনকি মাঝে মাঝে এমনও দেখা যায়, যে লাইসেন্সটি তার সাথে আছে সেটাও অন্যজনের। আরেকটি সমস্যা আমাদের দেশে রয়েছে সেটা হলো একই রাস্তায় নানা ধরনের যানবাহন চলার বিষয়টি। যেমন, যে রাস্তা দিয়ে রিকশা চলছে, সেই রাস্তা দিয়েই চলছে অটোরিকশা, প্রাইভেট কার, বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহন। এই ভিন্ন ধরনের যানবাহন যখন একসঙ্গে বিভিন্ন গতিতে চলে, তখন প্রতিযোগিতা ও বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, যা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এছাড়া হাইওয়েতে সব জায়গায় ডিভাইডার নেই। ডিভাইডার না থাকার কারণে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে, যা ভয়াবহ দুর্ঘটনার সৃষ্টি করে। বিশেষ করে ঈদ বা উৎসবের সময় এ ধরনের দুর্ঘটনা বেশি ঘটে এবং ইমার্জেন্সি রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়।
সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. কেনান বলেন, সবাইকে অনুরোধ করবো, চলাফেরায় সচেতন হোন। আর যারা গাড়ি চালক তাদেরকে বলবো, সাবধানে গাড়ি চালান। অতিরিক্ত ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালাবেন না। এসব বিষয় মেনে চললে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকটা কমে আসবে।
হাসপাতালের উন্নয়ন প্রসঙ্গে নিটোর পরিচালক বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি বিশ্বায়নের এই যুগে নিটোর হাসপাতালকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবো। যদি আমরা সেটা করতে পারি, তবে ইনশাআল্লাহ দেশের অর্থোপেডিক চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা অনেক কমে যাবে। দৃশ্যমান কোন পরিবর্তনের জন্য এক বছর খুব বেশি সময় না। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরে অনেক কাজ করেছি।’
তিনি বলেন, ‘গত একটি বছর কেটে গেছে জুলাই আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বড় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ফলে একদিকে যেমন সময়ও কম, আবার নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যেও কাজ করতে হচ্ছে। তবুও হাসপাতাল সচল রাখা, জরুরি সেবায় উন্নতি আনা, রোগীর সংখ্যা ও উপস্থিতি বাড়ানো এসব ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে। গত বছরের তুলনায় ইমারজেন্সি অপারেশনসহ মোট অপারেশনের সংখ্যাও বেড়েছে।’
হাসপাতালের সেবা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আগে শুধুমাত্র আউটডোরে সাধারণ চিকিৎসা দেওয়া হতো। এখন সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। জরুরি চিকিৎসাকেও আমরা সরাসরি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে এনেছি, যেখানে প্রফেসর পর্যায়ের ডাক্তাররা দায়িত্বে থাকছেন। এসব পরিবর্তন আনুষ্ঠানিকভাবে নোটিফিকেশন দিয়ে কার্যকর করা হয়েছে। এছাড়া ওটিতেও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের তত্ত্বাবধান ছাড়া অপারেশন হচ্ছে না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিক দিয়েও হাসপাতালের পরিবেশ এখন আগের চেয়ে অনেক উন্নত ও সুন্দর হয়েছে।’
কেবলমাত্র পঙ্গু হাসপাতাল বা নিটোরে গেলেই ভালো চিকিৎসা পাওয়া যাবে মানুষের এই ধারণাকে আপনি কীভাবে দেখেন? এ প্রসঙ্গে ডা. মো. আবুল কেনান বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে, শুধু নিটোরেই হাড় ভাঙা বা অর্থোপেডিক্স চিকিৎসা হয় এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। বাংলাদেশের সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অর্থোপেডিক্স বিভাগ এবং জরুরি বিভাগ আছে। জেলা সদর হাসপাতালগুলোতেও অর্থোপেডিক্স এবং জরুরি বিভাগ আছে। অনেক উপজেলা হাসপাতালে এখন অর্থোপেডিক্স ডাক্তারসহ জরুরি বিভাগ রয়েছে।
সুতরাং হাড় ভাঙলে বা এক্সিডেন্ট করলেই সারাদেশ থেকে সবাই নিটোরে আসবে এটা রোগীদের ভুল ধারণা।’
পঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় দেশে বিশেষায়িত হাসপাতালের প্রয়োজন আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নিটোর শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় হাসপাতাল। কিন্তু এক হাজার শয্যাবিশিষ্ট এই হাসপাতালটি দেশের সব দুর্ঘটনাগ্রস্ত বা ট্রমা রোগীদের চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট নয়। আমরা মনে করি, সময়ের সাথে সাথে এই সেবা আরও বাড়ানো দরকার। অন্তত দেশের প্রতিটি বিভাগে একটি করে ৫০০ শয্যার ট্রমা হাসপাতাল থাকা প্রয়োজন। এতে রোগীরা দ্রুত চিকিৎসা পাবে, কষ্ট কমবে এবং নিটোরের ওপরও চাপ হ্রাস পাবে। বর্তমানে এই হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ২০০টির বেশি অপারেশন হয়। প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ জন রোগী জরুরি বিভাগে আসেন, আর ৮০ থেকে ১০০টি জরুরি অপারেশন করতে হয়। এই বিশাল কাজের চাপ চিকিৎসকদের জন্য খুব চ্যালেঞ্জিং। তাই যদি প্রতিটি বিভাগে আলাদা ট্রমা হাসপাতাল স্থাপন করা যায়, জনগণ আরও ভালো সেবা পাবে এবং উপকৃত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
বাংলাদেশে অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংখ্যা যথেষ্ট কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে নিটোর পরিচালক বলেন, ‘বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কিছু ঘাটতি আছে, এটা সত্য।
তবে এখন ডাক্তারদের মধ্যে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রবণতা খুব বেশি। আধুনিক প্রযুক্তি ও জ্ঞানের যুগে সবাই বিশেষজ্ঞ হতে চায়। প্রতি বছরই অর্থোপেডিক্স বিভাগে নতুন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে। সুতরাং আমরা মনে করি, এই ধারা অব্যাহত থাকলে ট্রমা হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেওয়া সম্ভব হবে।’
বিভিন্ন দেশে এআই বা রোবটিক ট্রিটমেন্ট শুরু হয়েছে, আপনাদের এ ধরনের কোন ট্রিটমেন্ট চালু করার পরিকল্পনা আছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. কেনান বলেন, ‘রোবটিক চিকিৎসার চিন্তা আমাদের নেই, এ কথাটা ঠিক না। বর্তমানে আমরা সেই মাত্রায় প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করতে পারিনি। তবে যথাযথ সময় ও সুযোগ পেলে আমরা এই বিষয়টি বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করবো।’
সবেশেষে দেশের মানুষের প্রতি আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, হাড়ভাঙাসহ বেশিরভাগ চিকিৎসায় নিটোরে আসার প্রয়োজন নেই। দেশের সব মেডিকেল কলেজ, জেলা বা উপজেলা হাসপাতালে অধিকাংশ হাড় ভাঙা রোগীর চিকিৎসা করানো সম্ভব। তবে খুব জটিল রোগীর ক্ষেত্রে যেখানে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব থাকে, তখন তাদেরকে নিটোরে আসার প্রয়োজন হয়। জনগণের প্রতি আমার অনুরোধ, আপনারা প্রথমে কাছের হাসপাতালে চিকিৎসা নিন। বিশেষ করে যেখানে মেডিকেল কলেজ আছে, সেখানে প্রাথমিকভাবে চিকিৎসা নিলে অধিকাংশ সমস্যা সমাধান সম্ভব।
