সোমবার, নভেম্বর ১০, ২০২৫

কমছে বন্যার পানি বাড়ছে দুর্ভোগ

কমছে বন্যার পানি বাড়ছে দুর্ভোগ

ভারি বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এবং উজানের পাহাড়ি ঢল কমে আসায় সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। ধীরগতিতে পানি নামতে শুরু করেছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো থেকে কিছু কিছু মানুষ বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। আবার হাওড়াঞ্চলে পানি বাড়তে থাকায় নতুন করে মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছেন। তবে আশ্রয়কেন্দ্র ও বাড়িতে ত্রাণের সংকট দেখা দিয়েছে। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির জন্য দুর্ভোগের সীমা নেই। কোথাও ত্রাণবাহী নৌকা দেখলে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন মানুষ। সরকারিভাবে শুকনো ও রান্না করা খাবার ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে জানান বন্যার্তরা। এদিকে শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে বন্যার পানিতে নৌকা ডুবে রংপুর মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মিল্টনসহ দুজন মারা গেছেন। সিলেট নগরীতে গোসল করতে নেমে পানিতে ডুবে অভি নামে এক স্কুলছাত্র মারা গেছে। নেত্রকোনার কলমাকান্দায় গোসল করতে গিয়ে ডুবে রিফাত নামে এক শিশু মারা গেছে। অন্যদিকে উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে।

সিলেটে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এবং উজানের পাহাড়ি ঢল থামায় সিলেটে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত কোথাও বৃষ্টিপাতের খবর পাওয়া যায়নি। নদ-নদীর পানিও বাড়েনি। তবে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি ছয়টি পয়েন্টে এখনও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে টানা বর্ষণের পর শুক্রবার সকালে সিলেটের আকাশে সূর্যের দেখা মিলেছে। বিভিন্ন এলাকায় রোদ ঝলমল করায় জনজীবনে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। শুক্রবার বেলা ১টার দিকে বন্যার পানিতে গোসল করতে নেমে নগরীর মুক্তিরচক এলাকায় অভি (১৭) নামের এক স্কুলছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের ৩১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজমুল হোসেন। সিলেট তালতলা ফায়ার সার্ভিসের লিডার শহিদুন ইসলাম জানান, পানিতে গোসল করতে নেমে নিখোঁজ হয় স্কুলছাত্র। ফায়ার সার্ভিসের টিম স্থানীয়দের সহযোগিতায় তাকে উদ্ধার করে।

শুক্রবার সকালে নগরীর শাহজালাল উপশহর, যতরপুর, সোবহানীঘাট, মীরাবাজার, মেন্দিবাগ, তোপখানা, জামতলাসহ আশপাশের এলাকায় বাসাবাড়ি ও রাস্তায় হাঁটুপানি দেখা গেছে। সরজমিন পরিদর্শনকালে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পানি কিছুটা কমেছে। তবে নতুন করে বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাসের মধ্যে তারা চরম দুর্ভোগ ও আতঙ্কে রয়েছেন। শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে ২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।

তবে সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজিব জানিয়েছেন, আকাশে আরও মেঘ রয়েছে। ফলে নতুন করে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। নগরীর পাশাপাশি সীমান্তবর্তী পাঁচ উপজেলা গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ ও জকিগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তবে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ও পাহাড়ি ঢল থামায় পানি কমতে শুরু করেছে। একইভাবে সদর, ওসমানীনগর দক্ষিণ সুরমা, বিশ্বনাথ, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও বালাগঞ্জ উপজেলায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে রয়েছে।

জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, জেলার ওসমানীনগরে সর্বোচ্চ এক লাখ ৮৫ হাজার ও গোয়াইনঘাটে এক লাখ ৪৫ হাজারেরও বেশি মানুষ পানিবন্দি। এছাড়া কোম্পানীগঞ্জে ৯৫ হাজার ৫০০, জৈন্তাপুরে ৯০ হাজার, জকিগঞ্জে ৮৫ হাজার ও সদরে ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। নগরীর ২৩ ওয়ার্ডে ৬০ হাজার মানুষ বন্যাকবলিত। সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে আবহাওয়া ভালো থাকায় পানি কমছে। বৃষ্টিপাত না হলে পানি দ্রুত কমে যাবে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে বৃহস্পতিবার রাতে ছিল ২৭ হাজারের বেশি মানুষ। শুক্রবার সকাল ১১টার দিকে ২৩ হাজারের কিছু বেশি অবস্থান করছিলেন। পানি কমতে থাকায় অনেকে বাড়ি ফিরেছেন।

জেলা প্রশাসক আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বন্যার্তদের মাঝে শুকনো ও রান্না করা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। এটি চলমান থাকবে। বানভাসিদের জন্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে কোম্পানীগঞ্জের হাইটেক পার্ক ও জৈন্তাপুরের সারিঘাট এলাকায় ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় বিপুল পরিমাণ ফসলি জমি, মৎস্য ও পশুর খামার তলিয়ে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এদিকে শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে নৌকা ডুবে মেডিকেল ছাত্রসহ ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। উপজেলার ধানশাইল ইউনিয়নের দক্ষিণ কন্দুলী গ্রামে ঢলের পানিতে নৌকা ডুবে রংপুর মেডিকেল কলেজের ছাত্র মো. মোশারফ হোসেন মিল্টন ও তার বন্ধু আমানউল্লাহ মারা যান। মিল্টন (২১) ওই গ্রামের সুরহাব মিয়ার ছেলে। তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজের ৩য় বর্ষের ছাত্র। আমানউল্লাহ (২১) সাদামিয়ার ছেলে। তিনি শেরপুর তিনআনী কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র। এ সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন আরও ৫ জন। তাদের মধ্যে ৩ জনকে শেরপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

ঝিনাইগাতী থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) ইস্কান্দার হাবিবুর রহমান দুজনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, রংপুর মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী মিল্টন ঈদের ছুটিতে এসে কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে ফুটবল খেলা শেষে শুক্রবার দুপুরে নৌকা দিয়ে বাড়ির পাশে নিচু জায়গায় জমে থাকা পাহাড়ি ঢলের পানি দেখতে যান। এ সময় নৌকা উলটে গেলে পানিতে ডুবে মিল্টন ও আমানউল্লাহ মারা যান।

এছাড়া সিলেটের ওসমানীনগরের ৮টি ইউনিয়নের দুই শতাধিক গ্রামের সহস্রাধিক ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, হাটবাজার ও দোকানপাট প্লাবিত হয়েছে। এতে উপজেলার দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। আত্মীয়স্বজন বা পরিচিতজনদের বাড়িঘর ও বহুতল ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন অনেকেই। আর যারা কোথাও যাওয়ার জায়গা পাচ্ছেন না, তারা ছুটছেন আশ্রয় কেন্দ্রে। গত ২ দিন ধরে ভারি বৃষ্টিপাত না হলেও পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে বলে বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। টিউবওয়েল তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির সংকটও দেখা দিয়েছে। সিলেট-২ আসনের (ওসমানীনগর-বিশ্বনাথ) সংসদ-সদস্য প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী ৩ দিন উপজেলার বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে বানভাসি মানুষের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছেন। শুক্রবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত উপজেলার বুরুঙ্গা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় তিনি ত্রাণ বিতরণ করেন।